সাড়ে তিন বছর পর নিজ বাড়িতে ফিরলো জোড়া মাথার সেই রাবেয়া-রোকাইয়া
বিকেল সাড়ে চারটা নাগাদ হায়েচ গাড়িটি বাড়ির উঠোনে গিয়ে থামে। রাবেয়াকে কোলে নিয়ে বাবা রফিকুল ইসলাম এবং রোকাইয়াকে কোলে নিয়ে মা তাসলিমা খাতুন যখন গাড়ি থেকে নামলেন তখন সবার চোখে মুখে আনন্দের ঝিলিক।





এলাকাবাসী আর স্বজনদের ফুলেল শুভেচ্ছায় সিক্ত হলেন তারা। দুইবোনের মধ্যে রোকাইয়া শারীরিকভাবে নিষ্প্রভ থাকলেও, রাবেয়ার মুখে হাসি যেন লেগেই ছিল। তার মুখের হাসিতেই যেন আনন্দ ছড়িয়েছে সবার প্রাণে। বাবা-মায়ের সাথে হেঁটেই নিজের ঘরে যায় সে। আর দীর্ঘদিন পর স্বজনদের কাছে পেয়ে আবেগ আপ্লুত হয়ে পড়েন রাবেয়া-রোকাইয়ার মা তাসলিমা খাতুন।





এমন চিত্রের দেখা মেলে সোমবার (১৫ মার্চ) বিকেল সাড়ে চারটায় পাবনার চাটমোহর উপজেলার মুলগ্রাম ইউনিয়নের আটলংকা গ্রামে। সিএমএইচ-এ দীর্ঘদিনের চিকিৎসা শেষে জোড়া মাথা আলাদা হয়ে সাড়ে তিন বছর পর নিজেদের বাড়িতে ফিরলো বহুল আলোচিত রাবেয়া-রোকাইয়া। বাড়িতে পৌঁছার পর তাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নেয় স্বজন-প্রতিবেশিরা। রাবেয়া-রোকাইয়া ফিরে পেয়ে আন্দন্দে উদ্বেলিত গোটা গ্রাম। তাদের একনজর দেখতে ভীড় জমায় আশপাশের মানুষ।





পারিবারিক সুত্রে জানা গেছে, ২০১৬ সালের ১৬ জুন সিজারিয়ান অস্ত্রোপচারের মাধ্যমে জন্ম নেয় জোড়া মাথার জমজ শিশু রাবেয়া-রোকাইয়া। জন্মের পর থেকে দুশ্চিন্তা ভর করে শিক্ষক দম্পতি বাবা-মা রফিকুল ইসলাম ও তাসলিমা খাতুনের। কিভাবে কি করবেন ভেবে পাচ্ছিলেন না তারা। এমন পরিস্থিতিতে তাদের নিয়ে প্রতিবেদন প্রচার করে বিভিন্ন গণমাধ্যম। সেই খবর পৌঁছায় প্রধানমন্ত্রীর কাছে। তিনি দায়িত্ব নেন রাবেয়া-রোকাইয়ার চিকিৎসার।





এরপর ২০১৭ সালের মাঝামাঝিতে ঢাকার সিএমএইচে ভর্তির পর ডা. সামন্ত লাল সেনের নেতৃত্বে দেশী-বিদেশী অভিজ্ঞ চিকিৎসদের নিবিড় তত্তাবধানে চলে চিকিৎসা ও অস্ত্রোপচার। এই অস্ত্রোপচার ও চিকিৎসা কার্যক্রমে অংশগ্রহণ করেন হাঙ্গেরীর একদল বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকও।





দীর্ঘ চিকিৎসায় ৪৮টি জটিল অস্ত্রোপচারের পর আলাদা করা সম্ভব হয় রাবেয়া-রোকাইয়াকে। এতে অংশ নেন প্রায় ১০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক। অবশেষে সাড়ে ৩ বছর পর সোমবার বিকেলে বাবা-মায়ের সাথে বাড়ি ফেরে জোড়া মাথা আলাদা হওয়া রাবেয়া-রোকাইয়া। তাদের ফুলেল শুভেচ্ছায় বরণ করে নেন স্বজন ও প্রতিবেশিরা।স্থানীয়রা জানান, তারা কখনও ভাবতে পারেননি জোড়া মাথার রাবেয়া-রোকাইয়াকে আলাদা করা সম্ভব। এই অসম্ভব কাজ সম্ভব হওয়ায় খুশি তারা।





হতাশা কাটিয়ে নিজের সন্তানদের আলাদাভাবে ফিরে পাওয়ায় উচ্ছসিত রাবেয়া-রোকাইয়ার বাবা-মা। বাবা রফিকুল ইসলাম বলেন, জোড়া মাথার জমজ শিশু জন্মের পর আমাদের মাঝে হতাশা নেমে আসে। অনেকে অনেক রকম কথা বলেছে। কটু কথাও শুনতে হয়েছে। কিন্তু এখন সেই শিশুদের জন্য আজ সারাবিশ্বে আমি পরিচিত। রাবেয়া রোকাইয়ার বাবা হিসেবে আমি গর্বিত। প্রধানমন্ত্রী, চিকিৎসকসহ গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করে তাদের ধন্যবাদ জানান রফিকুল ইসলাম।





মা তাসলিমা খাতুন বলেন, এরপরেও যদি দেশে কারো জোড়া মাথার জমজ সন্তান জন্ম হয় তাদের বলবো, আপনাদের ভয় নেই। আমাদের সাথে সরকার আছে, হাঙ্গেরীর বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক টিম আছে। জোড়া মাথা আলাদা করা আর কঠিন কিছু নয়। আমাদের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী আছেন, যিনি মায়ের মতো বাংলাদেশের জনগণের সকল দু:খ কষ্ট মুছিয়ে দিতে অক্লান্তভাবে কাজ করে চলেছেন। আমাদের অশেষ কৃতজ্ঞতা প্রধানমন্ত্রীসহ চিকিৎসকদের।





রাবেয়া-রোকাইয়ার আসার খবর পেয়ে তাদের বাড়িতে ছুটে যান চাটমোহর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ সৈকত ইসলাম। তিনি গণমাধ্যমকর্মীদের জানান, মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে কৃতজ্ঞতা যে, চাটমোহরের মতো প্রত্যন্ত অঞ্চলের একটি পরিবারের দুর্দশার কথা জানতে পেরে তিনি দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এটি মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর বড় উদারতা ও মানবিকতার পরিচয়। উপজেলা প্রশাসন পরিবারটির পাশে থাকবে।




